নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা | গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স

সৈয়দ শামসুল হুদা কে.সি.আই.ই (১৮৬২-১৯২২) একজন ব্রিটিশ ভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা, নাসিরনগর উপজেলার অন্তর্গত গোকর্ণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে ত্রিতল বিশিষ্ট ভবনটি 'গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স' নামে পরিচিত। পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া কুমিল্লা জেলার অন্তরভুক্ত ছিল এবং ভারত বিভাজন এর পূর্বে পার্বত্য ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল।

নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা | গোকর্ণ নবাব বাড়ি কমপ্লেক্স


নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা
কে.সি.আই.ই.

১৯২১ সালে অবিভক্ত বাংলার সংস্কারকৃত লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় মুসলিম প্রেসিডেন্ট
জন্ম১৮৬২ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া
মৃত্যু১৯২২ কলকাতা
যাদের দ্বারা প্রভাবান্বিতজেরেমি বেন্থাম, উয়িলিয়াম অস্টিন এবং উইলিয়াম ব্লেকস্টোনের, হাফিজ
যাদেরকে প্রভাবিত
করেছেন
মুসলিম লিগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য


তার পিতা সৈয়দ রিয়াজত উল্লাহ সাপ্তাহিক দূরবীনের সম্পাদক ছিলেন।


জ্ঞানার্জন

সৈয়দ শামসুল হুদা তার নিজ গৃহে পিতার নিকট থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ও ইসলাম বিষয়ক প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ঐতিহ্যগত শিক্ষা সমাপনের জন্য হুগলী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। আধুনিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন ও ১৮৮৪ সালে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৮৮৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব ল' ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৮৮৯ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে হতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।


সৈয়দ শামসুল হুদা প্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে বিংশ শতাব্দীর গুড়ার দিকে তার সমকালীন সময়ের মুসলিম পণ্ডিত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করলেন।


  রাজনৈতিক কর্মজীবন

সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৮৫ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন এবং একই বছরে মাওলানা উবাইদুল্লাহ আল উবাইদি সোহরাওয়ার্দী মারা গেলে সৈয়দ শামসুল হুদা আরবি ও ফার্সি বিভাগে অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। পাশাপাশি কলকাতা হাইকোর্ট-এ আইন চর্চা শুরু করেন।


সেখান থেকেই তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৮৮৫ সালে কলকাতা হিন্দু নেতৃবৃন্দ দ্বারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। এই রাজনৈতিক অবকাঠামো ভারতের হিন্দু ও মুসলিম সম্মিলিত ভাবে সকল জনতার জন্য প্রতীকী প্রস্তাব পেশ করে। প্রখ্যাত ভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ - স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী প্রথমেই তাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে, হিন্দু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিভক্তির দিকে এগিয়ে গেলেন। ১৮৯৫ সালে মুসলিম নেতৃবৃন্দ কলকাতা ইউনিয়নের দ্বিতীয় বাৎসরিক সভার আয়োজন করেন। সৈয়দ শামসুল হুদা উক্ত সভায় যোগ দেন এবং বিভক্তির দিকে না গিয়ে সকল জনতাকে এক হওয়ার জন্য আহ্বান করে 'ভারতীয় রাজনীতি এবং মোহাম্মাদ'-এ শিরোনামে বক্তব্য রাখেন। তিনি তার স্পর্শকাতর বক্তৃতায় ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ এবং কীভাবে কংগ্রেসকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে প্রস্তাব রাখেন। বাজেটকৃত বরাদ্দের সমূদয় অর্থ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার নিকটে অবস্থিত জেলা সমূহে স্কুল, কলেজ, হাঁসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ব্যয় হয় বিধায় সৈয়দ শামসুল হুদা সর্বপ্রথম ১৯০৫ সালে বাজেটের বিরোধিতা করেন এবং সমভাবে পূর্ববাংলার উন্নয়নের জন্য নীতি গ্রহণের সুপারিশ করেন। তিনি এ বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠা করেন যে, এ উন্নয়ন পূর্ব বাংলার মুসলিম জনতার জন্য সুবিধাজনক হবে যদিও উচ্চ বর্ণের হিন্দুগণ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছিল। শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতন ও বিদ্বান হিসাবে সৈয়দ শামসুল হুদা নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন যা তিনি তার নিজের ভাষায় লিখেছেন:


«আমি মনেকরি, নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হওয়ার ফলে পূর্ববাংলার প্রতি সকলেরই ব্যক্তিগত মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে। বিভাগপূর্বকালে বিপুল পরিমাণ অর্থ কলকাতার অদূরে অবস্থিত জেলাসমুহে ব্যয় করা হতো। সেরা কলেজ, হাসপাতাল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমুহ ভারতের রাজধানী অভ্যন্তরে অথবা তার কাছাকাছি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন উভয় প্রদেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল, বাংলা এখন থেকে একাকী ঐ সকল সুবিধাদি পাওয়ার অধিকারী। আমরা বিগত বছরের সঞ্চিত অবহেলার এক ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকারী তাই [আমরা] যদি বড়অঙ্কের অর্থ নিজভূমের উন্নয়নের স্বার্থে রেখেদেয়ার দাবী করি তবে তাতে নিন্দা করার কিছু নেই।»


তিনি অন্যত্র লিখেনঃ

«তারা [হিন্দুগণ] পূর্ববঙ্গের রাজস্বে বহু বছর ধরে উপকৃত হয়ে আসছে, কিন্ত, এর উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য যৎসামান্যই ব্যয় করেছে...আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, যদি পূর্ববঙ্গ এখন কয়েক বছরের জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং উক্ত অর্থ পূর্ব বাংলার বাইরে কোনো প্রদেশ থেকে আসে, তাহলে তা পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসা উচিৎ এবং এতে, সেই প্রদেশের সভ্যদের এতটা অসন্তোষ প্রকাশ করার কিছু নেই।»


  অর্জন সমূহ

সৈয়দ শামসুল হুদা ১৯০২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি তার সভাপতির বক্তৃতায় 'ঠাকুর ল লেকচার' এ শিরোনামে বক্তব্য রাখেন যা Butterworth & Co,(India) Ltd কর্তৃক The Principles of the Law of Crimes in British India নামে অনুমোদিত হয়। তিনি জেরেমি বেন্থাম, উয়িলিয়াম অস্টিন এবং উইলিয়াম ব্লেকস্টোনের ব্যাখ্যার আলোকে মৌলিক মতাদর্শের ভিত্তিতে অপরাধ বিষয়ক আইনের সংস্কার আনয়ন করেন। তিনি ১৯০৪ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন। তিনি ১৯০৮ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের 'আইনসভার' এর সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের 'প্রেসিডেন্ট' নির্বাচিত হন। পূর্ববাংলার মুসলিম 'নেতা' হিসেবে ১৯১১ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।


«তিনি তাঁর প্রদেশে জননন্দিত অন্যতম নেতা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলনের পুরোধা।»


সৈয়দ শামসুল হুদা ১৯১২ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত 'গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল' এর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯১৩ সালে নবাব উপাধিতে ভূষিত হন এবং ১৯১৬ সালে কে.সি.আই.ই উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি ১৯১৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী পর কলকাতা হাইকোর্টে বাংলার দ্বিতীয় মুসলিম বিচারপতি হিসাবে অধিষ্ঠিত হন।


লর্ড কারমাইকেল বলেন


«আমার পক্ষ থেকে কল্যাণের সকল প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়ন করা এবং আপনাদের সম্প্রদায়ের (মুসলিমগনের) ন্যায্য দাবী সমূহ সঠিক ভাবে পূরণ করার জন্য আমার সহকর্মী মাননীয় নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদার কাছে থেকে যে পরামর্শ পেয়েছি, আমি এই সুযোগে তার সত্যতা স্বিকার করার মাধ্যমে আনন্দিত হচ্ছি যে, আমার বিচারে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়র জন্য তাঁর চেয়ে সহানুভূতিশিল বা উপযুক্ত কোন সমর্থক হতে পারে না।»


সৈয়দ শামসুল হুদা ১৯২১ সালে অবিভক্ত বাংলার সংস্কারকৃত লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় মুসলিম প্রেসিডেন্ট হন।


«তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের (সংশোধিত সংবিধানের অধীনে) অভিষেককৃত সভ্যের উচ্চ পদমর্যাদাপূর্ণ আসন অর্জন করেছিলেন যার প্রতি মানুষ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে থাকে। উক্ত আসন গ্রহণে ও অর্জিত ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগে বাংলা এবং তার অবকাঠামোগত সংস্কার আনয়নের মাধ্যমে যে প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়েছিল, তা সর্বদা সম্মানের সাথে স্মরণ করা হবে। ভগ্ন স্বাস্থ্য তাঁকে অবসর গ্রহনে বাধ্য না করা পর্যন্ত তিনি নিজেকে এবং তার ব্যতিক্রমী ক্ষমতাকে দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, তা যে-কেও স্মৃতির মণিকোঠায় কৃতজ্ঞতাভরে বন্দি করে রাখবে।»

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বর্ডার হাট | কসবা সীমান্ত হাট | কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

অর্জুনতলা মসজিদ - কুমিল্লা জেলার মসজিদ

হরিপুর বড়বাড়ি এবং হরিপুর রাজবাড়ি