কাইতলা জমিদার বাড়ি, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
কাইতলা জমিদার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে।
ইতিহাস
রহস্যময়ী কাইতলা জমিদার বাড়ি আজ বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত।বিলাসিনী তার আলো ঝলমলে রূপের সাথে হারিয়েছে গৌরবও।বিশ্বাস করতে একটু ভাবতে হয় এক সময় সেই দু'শ বছর পূর্বে ত্রিপুরা রাজার আমলে (অবিভক্ত ভারত শাসনামলে)এটি ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের একটি পূর্ণাঙ্গ জমিদার বাড়ি । ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বিশাল আয়তনের উপর প্রতিষ্ঠিত কাইতলার প্রাণ কেন্দ্রে ছিল সেই জমিদারের প্রাসাদ ।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের অধীন বৃহওর কুমিল্লার শাসক ছিলেন ত্রিপুরার রাজা বিরেন্দ্র কিশোর মানিক্য। ১৩১৯ সাল থেকে ১৬৬৬ পর্যন্ত ২৪ জন রাজা বৃহত্তর কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া শাসন করেন। সেসব রাজাদের অধীনেই ছিলেন জমিদাররা। আর তাদের অধীনে ছিলেন তালুকদাররা।
জমিদারের এ বাড়ি বর্তমানে এলাকাবাসীর কাছে ঐতিহাসিক "বড় বাড়ি "নামে পরিচিত ।
শুধু হেথায় হোথায় বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে থাকা কিছু ভগ্ন,অর্ধ ভগ্ন ইমারত টেরা কোটা পাথর আর গোটা কয়েক পুকুর ও দীঘি সাক্ষী রেখে অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে কাইতলা জমিদার বাড়ি । আভিজাত্যের শির উচু করে যে বাড়ি এক সময়ে সমস্ত এলাকা জুড়ে বিশাল ভূমিকা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল এখন সেই জমিদার বাড়ির দৈন্যদশা দেখে বিস্মিত হতে হয়। কোথায় সেই বিচারালয়ের ঘণ্টাধ্বণী, জলসাঘরের গমগম লহরী, পায়েলের জমজম সুর ঝংকার, নূপুরের নিক্কন, মায়াবী অট্টহাসির ধ্বনি-প্রতিধ্বনি? ধূলি ধূসরিত মেঠো পথের পাগলা হাতি সওয়ার, পাইক বড়কন্দাজ পেশকার, তহশিলদার, মোসাহেবের দল কোথায়? সন্দ্ব্যার ঝলমলে আলোক সজ্জায় উলুধ্বনিতে যে বাড়ী এক সময় মুখরিত হতো, সেই বাড়ীতে ভুল করেও কেউ উলুধ্বনি দেয়না। কেউ আলো জ্বালায় না। বাজেনা সন্দ্ব্যা পূঁজার ঘণ্টাধ্বনি। নেই সাধারন কৃষক প্রজার খবর নেবার তাড়না। ছুটে আসে না নজীর। ফরমান জারি করেন না এখন ।এখন শুধু দাড়িয়ে থাকা কিছু ভগ্ন ইমারত, নহবত খানা আর মন্দিরের সৌধমালা চোখে পড়ে। শুধু নিথর গুমোট আবহাওয়ার মাঝে কংকালসার দেহ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কাঁপে পুকুর দিঘীর জলরাশি। উন্মাদের মত হাহাহা করে হাসে প্রকৃতি।
জমিদার বাড়ী হারিয়ে ফেলেছে তার বিত্ত-বৈভব , দরবারি রূপ, ঐতিহ্যময় জৌলুস। একসময় জমিদার বাড়ীর পরতে পরতে শোভা পেত নানা বাহারী ফুল, রবি শস্যে ভরে যেত আঙিনা আর জ্ঞানী গুনী লোকদের পদচিহ্ন। কিন্তু কাইতলা জমিদার বাড়ী তার সেই অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনি। যে কারণে অনুসন্ধিৎসু মনের কাছে আমরা মুক ও বধির। আজ উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের অভাব,দখলদারিত্ব ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের চরম উদাসিনতায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত টেরাকোটা পাথর, ভগ্ন ইমারত ও সৌধ মালা কাঁদে নিরবে নির্জনে। এককালের অপূর্ব কারুকার্য খচিত ইমারত থেকে ঝুপ করে খসে পড়ে যায় জাফরি ইট। প্রাচীন লিপির পাথর ক্ষয়ে যায়। দীঘির প্রাচীন ঘাটে পাতলা ইট টলটলে পানিতে হারিয়ে যায়।কেউ কখনো তার খবরও রাখেনা। ত্রিপুরা রাজার রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যে সমস্ত উল্লেখ্য যোগ্য জমিদারগণ দায়িত্ব প্রাপ্ত থাকতেন তাদের মধ্যে কাইতলা জমিদার বাড়ীর জমিদারদের ভূমিকা কোন অংশেই কম ছিলনা।
সত্যিকার অর্থে ইংরেজ সরকার রাষ্ট্রের ভিত্তি দৃঢ় করণের জন্য জমিদার গোষ্টি সৃষ্টি করে। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য রাজা বাহাদুর, মহারাজা, স্যার, নাইট, খানবাহাদুর, রায় বাহাদুর প্রভৃতি উপাধি দিয়ে তাদেরকে সন্তষ্ট করত। ইংরেজদের এই দৌড়েও কাইতলার জমিদাররা পিছিয়ে ছিলেননা। নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, সেই কাইতলায় তৎকালীন সময়ে বিশ্বনাথ রায় চৌধুরী ছিলেন মূল জমিদার। এবং পর্যায়ক্রমে তার তিন পুত্র যথাক্রমে
(১)তিলক চন্দ্র রায় চৌধুরী
(২)অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরী এবং
(৩)ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরী জমিদারির তদারকি করেন।
শুনা যায় তারা পশ্চিম বঙ্গের শিম গাঁও নামক স্থান থেকে কোন এক সময় এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন।
নিঃসন্তান তিলক চন্দ্র রায় চৌধুরীর পর জমিদারির দায়িত্ব পান অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরী। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনিও ছিলেন নিঃসন্তান।তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেন বলে জানা যায়। অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরীর নামানুসারে আজও কসবা থানার বল্লভপুর গ্রামের পশ্চিমাংশকে অভয় নগর নামে অভিহিত করা হয়। অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরীর অধস্তন তিন পুরুষ পর জমিদার বংশের একমাত্র উওরসূরী অতিন্দ্র মোহন রায় চৌধুরী। যিনি এলাকার মানুষের কাছে হারু বাবু বলে সমধিক পরিচিত ছিলেন। কাইতলা যঁজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের কল্যাণে তিনি আমরন কাজ করে গেছেন। আমি লেখক তাকে দীর্ঘ সময় ধরে দেখেছি। মিশেছি। কথা বলেছি। অনেক তথ্য পেয়েছি। স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত অথচ তিনি ছিলেন চির কুমার। জমিদার বংশের নিবু নিবু এই প্রদীপ ২০০১ সালে মারা যান।
কালক্রমে অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরীর পর সুপ্রসন্ন ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরী জমিদারীর সমস্ত দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। বিভিন্ন জনহিতকর কাজের জন্য তিনি এখনো এলাকার মানুষের কাছে প্রাত স্মরণীয় হয়ে আছেন। জমিদার ঈশান রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে কসবা থানার মেহারী ইউনিয়নের একটি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে ঈশান নগর। হয়তো ঐ গ্রামের অনেক লোকেরাই জানেনা এ ধরনের নামকরণের তাৎপর্য। আপাদমস্তক জমিদার প্রকৃতির ঈশান রায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান ছিলেন যঁজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুুরী।পিতার মৃত্যুর পর তিনি জমিদারীর দায়িত্বও পান। তবে তার আমলে জমিদারী ও ঐশ্বর্যের ভান্ডারে ভাটার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল। একি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দুর্ভাগ্যক্রমে তিনিও ছিলেন নিঃসন্তান। তার সুযোগ্য পোষ্যপুত্র প্রফুল্ল বর্ধন ওরফে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চৌধুরী ব্যতীত জমিদার বংশের প্রায় সকলেই বিলাস ব্যসনের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন। সচেতন ও বিবেক সম্পন্ন পূজনীয় প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চৌধুরী গায়ের অক্ষর জ্ঞান শূন্য মানুষের কথা ভেবেই হয়তোবা নিজ বাবার নামে (পালক পুত্র হয়েও) গ্রামের দক্ষিণে তখনকার সময়ে ১৯১৮ সালে একটি মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ সময়ের প্রয়োজনে মাধ্যমিক স্কুলে পরিনত এবং সে স্কুলটি ১৯৯৭ ইংরেজি সন হতে এস এস সি পরীক্ষা কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে স্কুলটির পুরো নাম কাইতলা যঁজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়। এটি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার একটি স্বনামধন্য বিদ্যাপিঠ। বিনয়াবনত প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চৌধুরী গ্রামের মানুষের সুপেয় পানির সুবিধার্থে (পালক) মাতা সুখ মনি রায় চৌধুরানী ওরফে সুখ দেবীর (যঁজ্ঞেশ্বর রায়ের স্ত্রী ) স্মৃতিকে প্রানবন্ত করে রাখার উদ্দেশ্যে গ্রামের উওর পশ্চিমে প্রায় ৪০ একর আয়তন বিশিষ্ট একটি দীঘি খনন করে মায়ের নামানুসারে তার নাম রাখেন "সুখ সাগর"।
দোর্দান্ত প্রতাপে, ঘোড়ার খুরের ঠকঠক আওয়াজে, হাতির পিঠে বসে যে জমিদারেরা একসময় পুরো এলাকার রাজত্ব করত এই কাইতলার বড় বাড়ীতে বসে; সেই ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ী আজ স্মৃতির অন্তরালে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নতুন চরের মত এখানেও দখলদারের সংখ্যা অধিক। তিন ভাগে বন্টিত বড় বাড়ী ধ্বসে যাচ্ছে, শ্যাওলা ঢেকে দিচ্ছে প্রাসাদ দেয়াল। বর্তমান উওরসূরী শুধু এক ভাগ রেখে বাকী দুভাগ হাত ছাড়া করেছেন।আর হাত ছাড়া হওয়া দুভাগের পুরো অংশটুকুই আজ নিশ্চিহ্ন প্রায়। অস্তমিত সূর্যের মতই দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাসাদ-মন্দির। প্রাচীন ইট সুরকি পাথরের চাকতি বিক্রি করে উজাড় করে দেয়া হয়েছে। নাচ মন্দির, স্বর্ণমন্দির, শয়ন কক্ষ, অন্দর মহল,কয়েদ খানার কিছু চিহ্ন মাত্র যতটুকু ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আগে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার জন্য রক্ষা করা যেতে পারে।
জমিদার বাড়ী বর্তমানে "বড় বাড়ী" বলে পরিচিত। কাইতলা গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ জমিদার বাড়ীটি অত্র গ্রামের বাজারের উওর দিকের অপ্রশস্ত মেঠো পথ ধরে ৩/৪মিনিটের রাস্তার শেষ ঠিকানা। একসময় দক্ষিণ দিক থেকে জমিদার বাড়ীতে প্রবেশ কালে দেখা যেতো বাঘ সিংহ সাপ ড্রাগন ও বিভিন্ন লতাপাতায় কারুকার্য খচিত সিংহ দ্বারটি। এবং তারই উপরে নহবত খানাটি। স্থানীয় লোকেরা এটাকে বড় বাড়ীর গেইট নামে অভিহিত করে থাকেন। কোন এক সময় এখানে সারাক্ষণ লাঠি হাতে পাহারাদার মোতায়েন থাকতো। লতা পাতা জড়ানো শ্যাওলা আবৃত্ত অর্ধভগ্ন পড়মান নহবতখানা পেরুলেই দেখা যেতো দুধারে প্রাচীর করা পাথর নুড়ি আর পাতিল ভাঙা দিয়ে আবৃত্ত একটি প্রধান মেঠোপথ। যা কোন Visitor বা Tourist কে নিয়ে যেতো এবং এখনো নিয়ে যাবে বড় বাড়ীর মধ্যে নাচ মন্দিরের সামনের- ঘাসে ঢাকা খোলা মাঠে। মাঠের উওর দিকে নাচ মন্দিরের প্রাসাদের সামনে তৎকালীন নির্মিত বসার জন্য সিঁড়ি রয়েছে যা আজও বিদ্যমান। মাঠে বিভিন্ন সময়ে মেলা, গান, পুতুল নাচ, আশুরার দিন তাজিয়া মিছিলের মাতম ও খেলার আয়োজনে আজও বহু মানুষ সিঁড়িতে বসে তা উপভোগ করে। মাঠের দক্ষিণেই ছিল সুসজ্জিত চৈঠক খানা এবং তারই সাথে জমিদারদের প্রশাসনিক কার্যালয়ের সুন্দর ইমারত খানা। যা কিছু কাল পূর্বেও কাইতলা ৩৪১৭ কোড নং বা সাব পোষ্ট অফিস কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মাঠের পূর্বদিকে রয়েছে এ এলাকার সবচেয়ে বড় দীঘি। দু দিকে শান বাঁধানো পাকা ঘাট এবং কোন এক সময় পারিবারিক পূজা-আর্চনার প্রয়োজনেই হয়তোবা একটি ছোট মঠও ছিল। মাঠের পশ্চিমে ছিল বিরাট প্রাসাদ এবং কয়েদ খানা। যেখানে এখন লাউ ও কুমড়ো গাছের মাচা আর দোয়েল বুলবুলির আনাগোনা।
এই কয়েদ খানাই প্রমাণ করে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ খানদানি জমিদার বাড়ী ছিল।
মাঠের উওর দিকে চোখ ফিরালে দেখা যাবে রংচটা এবড়ো থেবড়ো আগাছা আর পরগাছায় মায়া মমতায় জড়ানো ভগ্ন একটি তিনতলা ভবন। ভবনের মাঝামাঝি একটি নাতিদীর্ঘ রাস্তা। আসুন আমরা সাবধানে সেখানে প্রবেশ করি। আমি নিশ্চিত এত শত বছর পরেও এখানে আপনি নিজেকে আবিস্কার করবেন নতুন ভাবে। এক অজানা সৌন্দর্য আপনাকে স্বাগত জানাবে।আপনি মনের অজান্তেই ছুটাছুটি করতে থাকবেন। চোখ আর মন এক হয়ে বলবে "আমি হারিয়ে গেছি অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।"এখানে উওর দিক থেকে শুরু হয়েছে অন্দর মহল ও অন্যান্য কক্ষ এবং সুখমণী রানী দেবীর বিশ্রামাগার ও প্রমোদ ভবন। এর উওর পূর্বে দাস দাসীদের কক্ষ। এছাড়া ভিতরে রয়েছে আরো বেশ কিছু কক্ষ। যেখানে ছিল পূজোরঘর, একান্ত পারিবারিক বৈঠক খানা। আরো কত্ত কি? মূল বাড়ীর একটু পশ্চিমে রয়েছে পাশাপাশি দুটো পুকুর। তার মধ্যে একটি পুকুর শত শত বছরেও খনন করা সম্ভব হয়নি। সারা বছরই ঘাসে আবৃত্ত এই পুকুরের নাম আন্দা পুকুর। গবেষণায় জানা যায় জমিদার বাড়ীর প্রতিটি দালান এত সুচারুভাবে নক্সা খচিত ছিল যে, বিভিন্ন ফুল পাখী লতা-পাতা, দেব দেবী বাঘ সিংহ সাপ ড্রাগন ইত্যাদি যা সাধারন মানুষের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করতো। সেই যুগে কিভাবে নির্মান করা হয়েছিল এত বড় বড় প্রাসাদ। দুতলা তিনতলা তাও আবার আজোপাড়া গায়ে -----ভাবতেও অবাক লাগে। আর এ নিয়ে হাজারো মনে হাজারো প্রশ্ন আজো দোলা দিয়ে যায়।
জানা যায় তৎকালীন এই এলাকার সাধারনত মানুষের কাছে জমিদার মানেই ছিল ভয়, শংকা। শত জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করেও অসহায় কৃষকদের বিনা মাহিনায় জমিদারদের জমি চাষ করতে হতো। বিনয়ের সাথে হাত করজোড়ে করেও জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতনা প্রজাসাধারণ। প্রজারা জমিদার ও কর্মচারী দিগকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করত। জমিদার বাড়িতে গরুর খাটি দুধ, টাটকা মাখন, ঘি, তরি তরকারী ঝাকা ভরে পৌঁছে দিতে হত। হিন্দু মুসলিম প্রজাদিগকে জমিদার বাড়ির উৎসবের জন্য বিভিন্ন ধরনের উপঢৌকন পাঠিয়ে জমিদারের মন সন্তুষ্ট করতে হত। জমিদারদের ন্যায় তার অধীন ম্যানেজার, ইন্সপেক্টর, নায়েব তহশীলদার, কেরানী, মহুরী, পাইক ও বড়কন্দাজ প্রজাদের অত্যাচার করত। খাজনা পরিশোধ না করলে প্রজাদের দুকাধে ভারী ইট দিয়ে রোদে দাড় করে রাখা হত। অনেক সময় তহশীলদারেরা প্রজাকে চৌকির নিচে আটকে রাখত। বিদ্রোহী প্রজাকে শীতকালে পানির মধ্যে বেধে রাখা হত, খাজনা পরিশোধ করলে ছেড়ে দেওয়া হত। জমিদারেরা খাজনা ব্যতীত আব-ওয়াব, তহুরী, মহুরী প্রভৃতি খাতে অন্যায়ভাবে টাকা আদায় করত। প্রজা খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে তহশীলদারেরা ভিটাই ঘুঘু চরিয়ে দেবে বলে ভীতি প্রদর্শণ করত। রায়তদের হাত পা শক্ত করে বেধে নাকে শুকনো মরিচের গুড়ো ঢুকিয়ে দেয়া হত।তাদেরকে নির্মম ভাবে বেত্রাঘাত করা হত। শাস্তি দেয়া হত নাভীর উপর গমর পিয়ালা রেখে। নব বধূকে পালকিতে চড়িয়ে, ছাতা কিংবা টুপি মাথায় দিয়ে, জুতা পায়ে দিয়ে কেউ জমিদার বাড়ী ঘেষে হাটতে পারতোনা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বেয়ারাদের গলা সমান ঠান্ডা পানিতে নামিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো।হাতির পিঠে চড়ে খাজনা আনতে যেতো অসহায় প্রজাদের বাড়ী।না পেলে আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতো সাধারন প্রজাদের বাড়ীঘর। প্রকৃতপক্ষে সেই জমিদারদের শাসন ছিল নিরিহ মানুষের উপর শোষন। অনেক মানুষের ধারণা তাদের ঐ সমস্ত অত্যাচারের পরিনতি হিসাবেই দেশ আজ জমিদারদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। অধিকাংশ জমিদার প্রজাপীড়ন করলেও যশোরের রাণী ভবানীর সুনাম ছিল। তিনি অনেক গরীব প্রজাদের খাজনা মওকুফ ও দান খয়রাত করে এ সুনাম অর্জন করেন। খুলনা অঞ্চলের একমাত্র হাজী মুহম্মদ মহসীন ব্যতীত প্রায় সমস্ত জমিদারই হিন্দু ছিল। ১৯৫০ সালে এই ভারতবর্ষে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও তার বহু পূর্বেই কাইতলার জমিদারদের হাত থেকে সাধারন মানুষ পরিত্রান পেয়েছিল। সে যাই হোক কাইতলা জমিদার বাড়ী আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের অহংকার। আমাদের অমলীন ইতিহাস। আমাদের কাছে স্মৃতির স্মারক। এ জমিদার বাড়ীর অনেক কিংবদন্তি ও গল্পগাঁথা আজো মানুষের মুখ থেকে মুখে মুখরিত। শুনা যায় তাদের সব মূল্যবান স্বর্ণালকার ও হীরা জহরত নাকী কলসিতে ভরে পাশের পুকুরে ডুবিয়ে রাখত। ঐ কলসি গুলো নাকি আবার মাঝে মধ্যে পুকুরে ভেসে উঠত। পুকুরে নাকি সিন্দুক ভেসে উঠত। রাত্রিকালে এ পুকুর থেকে ঐ পুকুরে যাওয়া আসা করতো স্বর্ণ, রূপা হীরা জহরত ভর্তি তামার পাতিল। আরো অনেক মুখরোচক কল্লকাহিনীতে আবর্তিত কাইতলা জমিদার বাড়ী রহস্য। তবে এখনো ভয়ে কেহ নামতে চায়না সেই আন্দা পুকুরে। ঘুটঘুটে কালো পানির পুকুরটি আজও বিদ্যমান। সত্যি কথা বলতে কি এখনও সেখানে গেলে গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠে। জমিদারহীন "বড় বাড়ী" সেই থেকেই হয়ে উঠেছিল এলাকার বিশেষতঃ কাইতলা গ্রামের মানুষের আড্ডাস্থল। বিকেলে ছেলে মেয়েদের বৌ চি, গোল্লা ছুট, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, হা-ডু-ডু, ফুটবল নানান খেলায় মুখরিত হয়ে উঠত জমিদার বাড়ীর উন্মুক্ত অঙন। বিভিন্ন সময় যুবকদের দ্বারা আয়োজিত যাত্রা, জারি গান হতো, পুতুল নাচ, বসতো বৈশাখী মেলা। দূরদূরান্ত থেকে পিকনিক পার্টি আসতো। আশে পাশের কারো বাড়ীতে নতুন মেহমান আসলে এ জমিদার বাড়ী না দেখে যেতোনা। এখনো জমিদার বাড়ীর আকর্ষণ কমেনি মানুষের কাছে। পূজা পার্বনে, বিয়ে, আ শুরায় এখনো ঢোল সানাইয়ের বাজনায় মুখরিত হয় জমিদার বাড়ীর আকাশ বাতাস। জমিদার বাড়ীর অস্থিমজ্জার সাথে মিশে আছে জমিদারদের ঐতিহ্য। নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত এ স্থানটির আবেদন প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে যুগান্তর প্রসারী। যে কেহ এখানে এসে এর শোভা স্নাত হবার নান্দনিক হাতছানি অনুভব করবেই। এখানকার অভ্যন্তরীণ কিংবা বহিঃপ্রকৃতির মুখশ্রী ও সৌন্দর্য সম্ভার অকবিকে কবি,অপ্রেমিককে প্রেমিক এবং ভাবনাহীনকে নিঃসন্দেহে ভাবুক করিয়া তোলার ক্ষমতা রাখে। এখনও যখন নহবত খানার সামনে দাড়াই, মাঠের সবুজ ঘাসে কিংবা সিঁড়িতে বসি, সুখ মণী রানী দেবীর অন্দর মহলে যাই কিংবা বড় দীঘির সিঁড়িতে অবসরে কিছু সময়ের জন্য বসি এক অদৃশ্য আমেজ অনুভূতিতে মন আপ্লুত হয়। বড় বাড়ীর কয়েকশো বছরের শ্যাওলা ঢাকা পুরনো প্রাচীন ইমারত গুলোর কক্ষে খুঁজি জমিদারদের ঐতিহ্য, ইতিহাস। কোথায় সেই বিলাস মন্দির? কোথায় সেই সুখ মণী দেবীর ঝমকালো মহল? এক সময় নহবত খানার ঢোল সানাই আর পায়েলের সুর মূর্চ্ছনায় যাদের ঘুম ভাঙত; খুঁজে ফিরি তাদের বড় বাড়ীর অন্তরে বাহিরে।
"ঈশান রায়ের বাড়ী,
অভয় রায়ের দাড়ি,
অবনী বাবুর ঘুম;
প্রফুল্ল বাবুর লোম।"
যেই জমিদার বাড়ীর জমিদারদের নিয়ে এলাকার মানুষ এরূপ ছড়া কাটতো, সে জমিদারেরা আজ নেই। জমিদার বাড়ী বিলীন হয়ে অন্তর্নিহিত হয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৮ সালে একটি প্রিন্টিং ম্যাগাজিনে আমি "স্মৃতির পাতায় কাইতলা জমিদার বাড়ী" শিরোনামে একটি গবেষণা ধর্মী প্রবন্ধ লিখেছিলাম। যা বিভিন্ন সাময়িকী তে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। এর পর জমিদার বাড়ীর প্রতি আমার মোহ আরো বেড়ে যায়। এবং আরো তথ্য সংগ্রহে নামি। কর্মজীবনে ব্যস্ততার কারণে প্রায় একযুগের ব্যবধানে গত ১৫/১২/২০১৬ তারিখে এক বাল্য বন্ধুসহ কাইতলা জমিদার বাড়ী দেখতে যাই। আমার কাছে মনে হয়েছে বড় বাড়ীকে আমরা আর বেশি দিন "বড় বাড়ী"হিসাবে দেখতে পাবোনা। এ আশংকা থেকেই আবার পুরনো প্রবন্ধটা নতুন করে লেখা। তবু যেটুকু ভগ্ন, অর্ধভগ্ন ইমারত কালের সাক্ষী হিসাবে দাড়িয়ে আছে তা সংরক্ষণ করা গেলেও নিজ চোখে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জমিদার বাড়ীর ঐতিহ্য দেখতে পাবে। খুঁজে নেবে ম্রিয়মাণ ইতিহাস।
তথ্য দাতাঃ
(১) স্বর্গীয় ডা.নিকুঞ্জ বিহারী সাহা।
(২) স্বর্গীয় গোপাল চন্দ্র রায় বর্ধন।
(৩) মরহুম এম শামসুজ্জামান।
(৪) সৈয়দ আলাউদ্দীন, বিসিএস (শিক্ষা )
(৫) স্বর্গীয় অতিন্দ্র মোহন রায় চৌধুরী (হারু বাবু)।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে এখানে জমিদার বাড়ির তিনটি ভগ্ন, শ্যাওলা ঢাকা প্রাসাদ, একটি দিঘী ও আন্ধা পুকুর নামে একটি জলাশয় রয়েছে।
এছাড়াও বাড়িটি অনেকটাই ভেঙে গিয়েছে এবং সেখানে কাইতলা গ্রামের মানুষ বসবাস শুরু করে দিয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন