ভৈরব রেলওয়ে সেতু, আশুগঞ্জ
ভৈরব রেলওয়ে সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব ও আশুগঞ্জ উপজেলার মাঝে মেঘনা নদীর উপর অবস্থিত একটি রেলওয়ে সেতু। একই স্থানে পাশাপাশি দুটি রেলওয়ে সেতু রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে “শহীদ আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতু” বা “ভৈরব প্রথম রেলওয়ে সেতু” (পূর্বে “কিং জর্জ-ষষ্ঠ সেতুু” নামে পরিচিত ছিল), এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে “জিল্লুর রহমান রেলওয়ে সেতু” বা “ভৈরব দ্বিতীয় রেলওয়ে সেতু”। সেতু দুটির পাশেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু অবস্থিত।
ইতিহাস
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু, ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে মেঘনা নদীর উপর নির্মিত সেতু। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু (ভৈরব সেতু নামেও পরিচিত) ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে মেঘনা নদীর উপর নির্মিত একটি সড়ক সেতু। এই সেতুটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সিলেটের সাথে ঢাকার যোগাযোগ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এই সেতুটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অংশ। এই সেতুর পাশেই ভৈরব রেল সেতু অবস্থিত। ভৈরব সেতু মেঘনা নদীর উপর অবস্থিত। সেতুটির নির্মাণকাজ ১৯৯৯ সালে শুরু হয় ও ২০০২ সালে সম্পন্ন হয়। সেতু নির্মাণে ৬৩৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। প্রথমে এই সেতুর নাম বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু রাখা হয়, পরে ২০১০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে নামকরণ করা হয়।প্রধান সেতুটির দৈর্ঘ্য ১.২ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৯.৬০ মিটার। এতে সাতটি ১১০ মিটার স্প্যান এবং দুটি ৭৯.৫ মিটার স্প্যান রয়েছে। এটি একটি টোল সেতু, সেতু কর্তৃপক্ষ পারাপার হওয়া যানবাহন থেকে টোল সংগ্রহ করে।
শহীদ আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতু বা ভৈরব প্রথম রেলওয়ে সেতু
শহীদ আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতু বা ভৈরব প্রথম রেলওয়ে সেতু (পূর্বে “কিং জর্জ-ষষ্ঠ সেতুু” নামে পরিচিত ছিল), হচ্ছে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব ও আশুগঞ্জ উপজেলার মাঝে মেঘনা নদীর উপর অবস্থিত একটি রেলওয়ে সেতু। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে প্রথম সেতুটির নির্মান কাজ শুরু হয় এবং ১৯৩৭ সালে শেষ হয়। সেতুটির উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রাজা ষষ্ঠ জর্জের নামানুসারে এই সেতুর নাম 'কিং জর্জ ষষ্ঠ সেতুু' রাখা হয়। এই সেতু দিয়ে প্রথম মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয় ১৯৩৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৩৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এর ওপর দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় সেতুটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সেতুটি পুনঃনির্মান করা হয়। পুনঃনির্মান শেষে ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেতুটি উদ্বোধন করেন। তখন সেতুটি নাম তার নামেই করার কথা ছিলো, তবে তিনি সেতু উদ্বোধন করতে গিয়ে জানতে পারলেন, এখানে যুদ্ধ চলাকালীন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন যার নাম হাবিলদার আবদুল হালিম। তিনি সাথে সাথে সিদ্ধান্ত পাল্টে সেতুটির নামকরণ করেন ‘শহীদ আবদুল হালিম রেলওয়ে সেতু’। এ সেতুটি ৯১৪ মিটার দীর্ঘ। এতে শুধুমাত্র মিটার-গেজ ট্র্যাক রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান রেলওয়ে সেতু বা ভৈরব দ্বিতীয় রেলওয়ে সেতু
রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান রেলওয়ে সেতু বা ভৈরব দ্বিতীয় রেলওয়ে সেতু বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব ও আশুগঞ্জ উপজেলার মাঝে মেঘনা নদীর উপর অবস্থিত একটি রেলওয়ে সেতু। একই স্থানে পাশাপাশি দুটি রেলওয়ে সেতু রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে “শহীদ আব্দুল হালিম রেলওয়ে সেতু” বা “ভৈরব প্রথম রেলওয়ে সেতু” (পূর্বে “কিং জর্জ-ষষ্ঠ সেতুু” নামে পরিচিত ছিল), এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে “জিল্লুর রহমান রেলওয়ে সেতু” বা “ভৈরব দ্বিতীয় রেলওয়ে সেতু”। সেতু দুটির পাশেই সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু অবস্থিত।২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইনের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতুর নির্মাণ শুরু হয়। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ও এফকন্স যৌথভাবে বর্তমান ভৈরব প্রথম রেলওয়ে সেতুর ৪০ মিটার দক্ষিণ প্রান্তে আরও একটি রেল সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে। প্রকল্পের মেয়াদ অনুযায়ী ২০১৬ সালের জুন মাসে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ২০১৫ সালে ঘন ঘন হরতাল অবরোধের প্রভাব আর বর্ষা মৌসুমে নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় সেতুটির নির্মাণ কাজ বাধাগ্রস্ত হয়, ফলে প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি। প্রথম ধাপে নির্মাণ কাজের সময়সীমা ৬ মাস বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ভারতের কলকাতা থেকে নৌপথে বাংলাদেশের ভৈরবে সেতুর ‘স্প্যান’ আনার পথে নৌ-দুর্ঘটনার শিকার হয় একটি কার্গো। ফলে সেতুটির নির্মাণ কাজে বিলম্ব হয় এবং পরে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্বিতীয় দফায় আরও ৬ মাস প্রকল্পের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুন মাসে নির্ধারিত করা হয়। পরে ২০১৭ সালে নির্মানকাজ শেষ হয় এবং ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর সেতুটি উদ্বোধন করা হয়। ৫৬৭ কোটি ১৬ লাখ/৬২০ কোটি বাংলাদেশী টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মিত। অর্থের জোগান এসেছে ভারতীয় ঋণ সহায়তা (এলওসি ফান্ড) থেকে। এর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও ভারতীয়। ইরকন-এফকনস জেভি নামে একটি কোম্পানি সেতুটি নির্মাণ করছে। সেতুটি ইস্পাতের তৈরি। এতে মোট ১২টি পিলার ও ৯টি স্প্যান রয়েছে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১০০ মিটার, ভর ৮০০ টন। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯৮৪ মিটার/১.০২ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৭ মিটার। এতে মিটার-গেজ ও ইন্ডিয়ান-গেজ মিলে ডুয়েল-গেজ ট্র্যাক রয়েছে। সেতুটি বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ঘটনা ও দুর্ঘটনা
১২/০২/১৯৫০: অ্যান্ডারসন সেতুর হত্যাকাণ্ড
অ্যান্ডারসন সেতুর হত্যাকাণ্ড বলতে ১৯৫০ এর ১২ই ফেব্রুয়ারি অ্যান্ডারসন সেতুর ওপর পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসনের মদতে বাঙালি হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর করা হত্যাকাণ্ডকে বুঝায়।
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের জেরে এই দিন সেতুর ওপর বিশেষ পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতে পলায়নরত হিন্দুদের হত্যা করা হয়। আনসাররা সেতুর দুপ্রান্তে ভৈরব বাজার জংশন বা আশুগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়তো। ট্রেন হাইজ্যাক করে ভেতর থেকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতো। সম্পূর্ণভাবে সেতুর ওপর উঠে পড়লে চালক ট্রেন থামিয়ে দিতো। এরপর আনসাররা প্রত্যেক হিন্দুকে এক এক করে টেনে বের করে এনে তাদের হত্যা করে মৃতদেহটা সেতুর ওপর থেকে নদীর জলে ফেলে দিতো। তথাগত রায়ের মতে, এই হত্যাকাণ্ডটা সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করেই করা হয়েছিল। ট্রেনের চালক, পরিচালকসহ সমস্ত রেলকর্মীই এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত।[
১৩/১২/১৯৭১:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই দিন দুপুর দেড়টা থেকে দুটোর দিকে ভৈরব রেল সেতুটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে সেতুটির ভৈরব অংশের দুটি স্প্যান ও আশুগঞ্জ অংশের একটি স্প্যান ভেঙে পড়ে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন